ইসমাইল হোসেন কিরন, হাতিয়া নোয়াখালী : ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, মঙ্গলবার, ১৩:৪৮:৫৫
চরটিতে কোনো প্রাথমিক বিদ্যালয় নেই। গড়ে উঠেনি মাদ্রাসাসহ অন্য কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও। সবাই ব্যাস্ত খেতে খামারের কাজে। এদের বয়স ৮-১২ বছরের মধ্যে। যে বয়সে বই নিয়ে স্কুল কিংবা মাদ্রাসায় যাওয়ার কথা, সেই বয়সে এসব শিশুর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণের কোনো সুযোগ নেই।
এমনকি জন্মেও পর এসব শিশুর কাউকেই দেওয়া হয়নি ৬টি রোগের টিকাও। স্বাস্থ্য ঝুঁকিসহ অনিশ্চিত ভবিষ্যত নিয়ে বেড়ে উঠছে এসব শিশু। নোয়াখালী দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ার বিচ্ছিন্ন দ্বীপ চরগাসিয়ার প্রায় ৫ সহস্রাধিক শিশুর চিত্র এটি।
২০১৩ সাল থেকে এই চরে মানুষের বসবাস শুরু হয়। ট্রলারে যাতায়াত করতে হয় এই চরের বাসিন্ধাদের। নদী পাড়ি দিয়ে এখানাকার মানুষকে দেশের মূল ভুখন্ড ও উপজেলা সদরে যাতায়াত করতে হয়।
ইউনিয়ন পরিষদের কার্যক্রম না থাকায় নেই ওয়ার্ডের বিভাজনও। নিজেদের প্রয়োজনে ৬টি সমাজে বিভক্ত হয়ে প্রায় ১০-১২ হাজার পরিবার বসবাস করছে এই চরে। স্থানীয়রা জানান, এসব পরিবারের বিদ্যালয়ে যাওয়ার মত শিশুর সংখ্যা ৫ হাজারের উপরে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান না থাকায় এই চরের শিশুরা দিনের বেশির ভাগ সময় পারিবারিক কাজে ব্যস্ত থাকে।
বারআউলিয়া সমাজের অবস্থান চরের উত্তর পাশে। এর নামানুসারে গড়ে উঠেছে বারআউলিয়া বাজার। বাজারের উত্তর পাশে খালের পাড়ে এক খন্ড জমিতে বসবাস করেন মো: জসিম (৪৭)। পেশায় দর্জি জসিম এক সময় বসবাস করতেন হাতিয়ার তমরদ্দি ইউনিয়নের জোড়খালি গ্রামে।
সরেজমিনে, জসিমের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, ছোট তিনটি শিশু নিয়ে স্ত্রী জেসমিন বাড়িতে রান্নার কাজ করছেন। চার বছর আগে বসবাস শুরু করলেও এখনো পরিপূর্ণ বসত ঘর তৈরি করতে পারেননি। নেই রান্নার ঘর। থাকার ঘরের বাইরে খোলায় জায়গায় চুলা বসালে বাতাসে রান্না করা যায় না। তাই বসবাস করা ঘরের মধ্যে চুলা তৈরি করে তাতে রান্না করছেন। তিন শিশু সন্তান ছোট উঠানে মাটিতে বসে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে খেলাধূলা করছে। সবার গায়ে লেগে রয়েছে ধুুলাবালি।
প্রশ্নের জবাবে জেসমিন জানান, প্রাথমিক বিদ্যালয় নেই চরে। তাই শিশুরা বাড়িতে অবস্থান করছে। তিন সন্তানের মধ্যে বড় মেয়ে রাবেয়ার বয়স ৯ বছর। এখনো প্রাতিষ্ঠানিক কোন শিক্ষা দেওয়া যাচ্ছে না তাকে। চরে কোথাও প্রাথমিক বিদ্যালয় নেই। তাই বাড়িতে থেকে সংসারের কাজকর্ম করে দিন কাটে তঁর। একই অবস্থা দ্বিতীয় সন্তান রাহেলারও। তারও বয়স ৭ বছরের মত।
জসিমের বাড়ির পাশে কৃষক নুর হোসেনের বাড়ি। সাংবাদিকদের দেখে এগিয়ে এসে জানান, বিদ্যালয় নেই এই চওে, তাই ছেলে মেয়েরা পড়া লেখা করতে পারছে না। জন্মের পর থেকে এসব শিশুদের দেওয়া হয়নি টিকা।
সরকার শিশুদের দেওয়া টিকা কার্যক্রমের উপর যেভাবে গুরুত্ব দিচ্ছে তা এই চরে অনুপিস্থত। দুটি মেয়ে সন্তানসহ তার চার সন্তানের কেউ টিকা পায়নি। একছেলে বাজারের মসজিদের নুরানী মাদ্রাসায় যায় মাঝে মধ্যে। বর্ষায় রাস্তা না থাকায় তাও যাওয়া সম্ভব হয় না।
নুর হোসেন আরো জানান, এই নুরানী মাদ্রাসাটি স্থানীয় এক হুজুরের তত্বাবধানে পরিচালিত হয়। ভালো কোনো লেখা পড়া সেখানে হয় না। চরে এ ধরনের আরো ৩টি নুরানী মাদ্রাসা রয়েছে। এসব মাদ্রাসার শিক্ষকদের যোগ্যতা নিয়েও হতাশা ব্যক্ত করেন তিনি ।
সরেজমিনে চরের বিভিন্ন অংশে দেখা যায়. শিশুরা বড়দের সাথে খেতে খামারে কাজ করছে। অনেকে গরু-ছাগল লালন পালন করছে। বিকালে স্থানীয় বাজারের চায়ের দোকানে দেখা যায় এসব শিশুরা টিভি দেখায় মগ্ন। এদের মধ্যে একজন তরিকুল (১০)। সে চরের পশ্চিম পাশে ইসলামপুর সমাজে বসবাস করে।
তরিকুল জানায়, সারাদিন পরিবারের বড়দের সাথে কাজ করে। বিকাল হলে বাজারের টিভি দেখতে চলে আসে। চরে এসেছে ৬ বছর বয়সে। এখানে কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান না থাকায় বিদ্যালয়ে যাওয়া হয়নি তার।
এই চরে বাসিন্দাদের চিকিৎসার বিষয়ে পল্লী চিকিৎকের উপর ভরসা করতে হয়। রনজিত দাস এই চরের পরিচিত একজন পল্লীচিকিৎসক। রনজিত জানান, এই চরে শিশুদেরকে টিকা দেওয়া হয় না। জন্মের পর সবাই টিকা ছাড়াই বড় হচ্ছে। এতে হাম, যক্ষাসহ বড় রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশংকা থেকে যায়।
রনজিত আরো জানান, চরে ৭ বছর ধরে পল্লী চিকিৎসা পেশায় আছেন তিনি। জ্বও, সর্দি ও কাশি হলে মানুষ তার কাছ থেকে পরামর্শ নিয়ে ঔষধ খেয়ে থাকেন। জটিল রোগ হলে মানুষকে নদী পাড়ি দিয়ে উপজেলা সদর ওচখালী যেতে হয়।
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের স্বাস্থ্য পরিদর্শক আবু সালেহ মো: কবির জানান, শিশুদের দেওয়া টিকা নিদির্ষ্ট তাপমাত্রায় রাখতে হয়। চরগাসিয়ায় বিদ্যুতের ব্যবস্থা নেই। এজন্য সেখানে টিকা কার্যক্রম চালানো যাচ্ছে না। এছাড়া যোগাযোগ ব্যবস্থা খুবই নাজুক। একটি ট্রলার দিনে একবার যায়, পরদিন ফিরে আসে। দিনে ফিরে আসার সূযোগ নেই। স্বাস্থ্য কর্মীদের থাকার কোনো ব্যবস্থা নেই এই চরে।
উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা কামরুল ইসলাম জানান, নতুন জেগে উঠা এই চরে স্থানীয় সরকারের সকল কার্যক্রম অনুপস্থিত। মানুষজন বসবাস শুরু করেছে কয়েক বছর আগ থেকে। সেখানে চরে একটি আশ্রয়কেন্দ্রও নেই। তাই প্রাথমিক বিদ্যালয় চালু করার মত কোন অবকাঠামো পাওয়া যাচ্ছে না।
এ ব্যাপারে হাতিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো: কায়সার খসরু বলেন, ১নং হরনী ইউনিয়নের অংশ চরগাসিয়া। হাতিয়া উপজেলা সদর থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ায় অনেক উন্নয়ন সেখানে চাইলেও সম্ভব হয় না। জেলা প্রশাসকসহ উর্ধ্বতন অনেক কর্মকর্তা এই চর পরিদর্শন করে এসেছেন। এই চরকে সিডিএসপি প্রকল্পের মাধ্যমে উন্নয়নের প্রক্রিয়া শুরু করা হয়েছে।
For add