সাজ্জাদ এইচ রাকিব, বন্দর (চট্টগ্রাম) প্রতিনিধি : ৩ মার্চ ২০২৩, শুক্রবার, ১৬:৫০:০৪
বৈশ্বিক সংকটের মধ্যেও বিদেশি জাহাজ থেকে বেড়েছে চট্টগ্রাম বন্দরের আয়। বছরজুড়ে বিদেশি জাহাজ ভিড়িয়ে এ খাতে গত বছরের চেয়ে প্রায় ৩৯ কোটি টাকা বেশি রাজস্ব পেয়েছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। চলতি বছর এ খাতে বন্দরের আয় ৫২৬ কোটি। যদিও মার্কিন ডলারের দাম বাড়ার কারণে গতবছরের শেষদিকে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে পণ্য আমদানিতে স্থবিরতা নেমেছিল।
বন্দর কর্তৃপক্ষ বলছে, মূলত রাজস্ব আয় বৃদ্ধি নির্ভর করে কনটেইনার হ্যান্ডেলিংয়ের ওপর। বিভিন্ন কৌশল ও যুগোপযুগী সিদ্ধান্ত ও বৈদেশিক জাহাজের আগমনের সংখ্যা দিনকে দিন বাড়ার কারণে রাজস্ব আয় বাড়ছে বলে দাবি তাদের।
চট্টগ্রাম বন্দর সূত্রে জানা গেছে, ২০২১-২২ অর্থবছরে জাহাজের মোট পরিচালনা আয়ের মধ্যে শুধু বৈদেশিক জাহাজ থেকে রাজস্ব এসেছে ৫২৬ কোটি ৩৪ লাখ টাকা। বিপরীতে ২০২০-২১ অর্থবছরে ৪৮৭ কোটি টাকা রাজস্ব আসে বিদেশি জাহাজ পরিচালনা করে।
তাছাড়া বিদেশি জাহাজ পরিচালনা করে ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৪৮৪ কোটি ২০ লাখ টাকা, অপরদিকে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৪৩৬ কোটি টাকা আয় আসে বন্দরের।
এছাড়া প্রতিটি বিদেশি জাহাজ থেকে ২০২১-২২ অর্থবছরে ১৭ লাখ ৬৬ হাজার টাকা, ২০২০-২১ অর্থবছরে ১৮ লাখ ১০ হাজার টাকা, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ১৬ লাখ ৩০ হাজার টাকা ও ২০১৮-১৯ অর্থবছরে প্রতি জাহাজ থেকে ১৫ লাখ ২০ হাজার টাকা আয় করেছে চট্টগ্রাম বন্দর।
বন্দর সংশ্লিষ্টরা জানান, চট্টগ্রাম বন্দরে প্রতিদিন বিপুল পরিমাণে পণ্য উঠনামা হয়ে থাকে। এর মাধ্যমেও রাজস্ব আয় করে বন্দর। সে রাজস্ব আয়ের পরিমাণও বছরের ব্যবধানে বেড়েছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে পণ্য উঠানামা করে ২ হাজার ৪৯৫ কোটি ৩২ লাখ টাকা আয় করে বন্দর।
তাছাড়া পণ্য উঠানামা বাবদ ২০২০-২১ অর্থবছরে ২ হাজার ৩০৪ কোটি ৬২ লাখ টাকা, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ২ হাজার ৩৭৬ কোটি ২৮ লাখ টাকা, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ২ হাজার ৩৭৯ কোটি ৫৫ লাখ টাকা পণ্য উঠানামা বাবদ আয় করে বন্দর। পাশাপাশি ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রতি টন পণ্যে রাজস্ব এসেছিল ২ কোটি ৫৭ লাখ ৯৭ হাজার টাকা, ২০২০-২১ অর্থবছরে ২ কোটি ৪৮ লাখ ২৯ হাজার টাকা ও ২০১৯-২০ অর্থবছরে ২ কোটি ৩৩ লাখ ৯৭ হাজার টাকা রাজস্ব আদায় হয়েছিল।
বন্দর সংশ্লিষ্টরা আরও জানান, গতবছর সার্বিকভাবে খারাপ পরিস্থিতির মধ্যেও বন্দরে জাহাজ আগমনের সংখ্যাও আগের তুলনায় বেড়েছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে ২ হাজার ৯৮০ জাহাজ এসেছিল বন্দরের জেটিতে। ২০২০-২১ অর্থবছরে ২ হাজার ৬৯৩টি জাহাজ, তার আগে ২০১৯-২০ অর্থবছরে ২ হাজার ৯৭০টি জাহাজ ও ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ২ হাজার ৮৬৮টি জাহাজ এসেছিল।
অপরদিকে জাহাজ বহির্গমনের সংখ্যা বছরের ব্যবধানে কিছুটা কমেছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে ২ হাজার ৯৫০টি বহির্গমন হয়েছিল। তাছাড়া ২০২০-২১ অর্থবছরে ২ হাজার ৯৯০টি জাহাজ, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ২ হাজার ৯৬০ ও ২০১৮-১৯ অর্থবছরে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে বহির্গমন হয়েছিল ২ হাজার ৮৫০টি জাহাজ।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে কমেছে আমদানি ও রপ্তানি মালামাল খালাসের পরিমাণ। ২০২১-২২ অর্থবছরে ৮৪২ লাখ টন আমদানি করা মালামাল খালাস করেছে চট্টগ্রাম বন্দর। এর আগে ২০২০-২১ অর্থবছরে ৯৩৯ লাখ টন, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৮৯১ লাখ টন ও ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৮২৯ লাখ টন আমদানি করা পণ্য খালাস করা হয়েছে।
অপরদিকে ২০২১-২২ অর্থবছরে ১২৫ লাখ টন পণ্য রপ্তানি করা হয়েছে। অথচ ২০২০-২১ অর্থবছরে ১৮১ লাখ টন, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ১৬৯ লাখ টন ও ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ১৫২ লাখ টন পণ্য রপ্তানি করা হয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দরের তথ্যমতে, দু’বছরের ব্যবধানে চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজ অবস্থানের জন্য বার্থ ও মুরিংয়ের সংখ্যা বেড়েছে।
২০১৯ সালে চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজ অবস্থানের জন্য ১৭টি বার্থ ও ১৯টি মুরিং ছিল। বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দরে সে সংখ্যা বেড়ে ১৯টি বার্থ ও ৩৫টি মুরিং রয়েছে। ২০২১-২০২২ অর্থবছরে দেশের প্রধান এই সমুদ্রবন্দরে কন্টেইনার হ্যান্ডলিং হয় ৩২ লাখ ৫৫ হাজার ৩৫৮ টিইইউস কন্টেইনার।
এছাড়া ২০২০-২১ অর্থবছরে চট্টগ্রাম বন্দরে মোট ৩০ লাখ ২০ হাজার টিইইউএস কনটেইনার হ্যান্ডলিং করা হয়েছে। তার আগের অর্থবছরেও একই ধারা বজায় ছিল। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ২৯ লাখ ১৯ হাজার টিইইউএস কনটেইনার হ্যান্ডলিং করা হয়েছিল।
জানা গেছে, ১৯৯৭ সাল থেকে ২০১৪ পর্যন্ত ১৮৬ মিটার লম্বা এবং ৯ দশমিক ১০ মিটার ড্রাফটের জাহাজ বন্দরে ভেড়ানো যেত। এরপর আরও বড় জাহাজ ভেড়ানোর সুবিধা চালু করা হয়। ২০১৫ সাল থেকে সর্বোচ্চ ১৯০ মিটার লম্বা ও সাড়ে ৯ মিটার ড্রাফটের জাহাজ বন্দরে ভেড়ানো যেত। সাতবছর পর চলতি বছরের শুরুতে আরো বড় জাহাজ ভিড়িয়ে নতুন ইতিহাস তৈরি করে চট্টগ্রাম বন্দর।
বছরের শুরুতে অর্থাৎ গত ১৬ জানুয়ারি বন্দরের সিসিটি-১ নম্বর জেটিতে ভেড়ানো হয়েছিল ১০মিটার গভীরতা ও ২০০ মিটার দৈর্ঘ্যের বড় জাহাজ ‘কমন এটলাস’। এরপর গত ২৬ ফেব্রুয়ারি উদ্বোধনের আগেই পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনালে প্রথমবারের মত ভিড়েছে ২০০ মিটার দীর্ঘ এবং ১০ মিটার গভীরতার বড় জাহাজ।
বাংলাদেশি পতাকাবাহী জাহাজ ‘মেঘনা ভিক্টোরি’র মাধ্যমে নবনির্মিত এ টার্মিনালে উদ্বোধনের আগেই বড় জাহাজ ভেড়ানোর রেকর্ড গড়লো।
বন্দর কর্মকর্তারা বলছেন, বন্দর জেটিতে এখন বড় জাহাজ ভেড়ানো সম্ভব। তাই ভবিষ্যতে বন্দর জেটিতে বিদেশি জাহাজ আগমনের সংখ্যা আরো বাড়বে। এতে করে পণ্যর আমদানি-রপ্তানি বাড়ার পাশাপাশি বন্দরের রাজস্ব আদায়ের পরিমাণও অনেক বাড়বে।
চট্টগ্রাম বন্দরের সচিব মোহাম্মদ উমর ফারুক বলেন, নানা প্রতিকূলতার মাঝেও গতবছর বন্দরে জাহাজ আগমন, কন্টেইনার ও কার্গো হ্যান্ডলিংয়ে ধারাবাহিকতা বজায় ছিল। একদিকে জাহাজ আগমন বেড়েছে, অপরদিকে কনটেইনার পরিবহনে তিন মিলিয়নের ক্লাব থেকেও আমরা ছিটকে পড়িনি।
গতবছর জাহাজ আগমনের পরিমাণ বাড়ায় জাহাজ থেকে আয়টা বেড়েছে। এখন আমাদের জেটিতে ২০০ মিটার দীর্ঘ এবং ১০ মিটার গভীরতার বড় জাহাজ ভেড়ানো সম্ভব। পাশাপাশি ইংল্যান্ড, নেদারল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে সরাসরি জাহাজ চলাচল শুরু হয়েছে। তাই আশা করছি সামনে জাহাজ আগমন এবং এটা থেকে রাজস্ব আয়ের পরিমাণ আরও বাড়বে।
শিপিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের পরিচালক খায়রুল আলম সুজন বলেন, চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা দিনে দিনে বাড়ছে। বন্দর এখন ১০ মিটার গভীরতা ও ২০০ মিটার দৈর্ঘ্যের বড় জাহাজ ভেড়ানোর সক্ষমতা অর্জন করেছে। বৈশ্বিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে পণ্য আমদানি-রপ্তানির পরিমাণ আরও বেড়ে যাবে। তখন জাহাজ আগমনের সংখ্যাও বাড়বে।
সর্বশেষ খবর ওশানটাইমস.কম গুগল নিউজ চ্যানেলে।
Tags: চট্টগ্রাম, চট্টগ্রাম বন্দর, জাহাজ
For add